সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:৫২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক॥
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আন্দোলন-কর্মসূচির চাপ কমেছে বিএনপিতে। সেইসঙ্গে কমেছে মামলা-হামলার চাপও। ফলে অপেক্ষাকৃত স্বস্তিতে থাকলেও আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চ্যালেঞ্জ মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে কৌশলে ধানের শীষের প্রচার ও গণসংযোগ করা হচ্ছে। নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে সতর্কভাবে এগোতে চায় দলটি। তৃণমূলে সাংগঠনিক ভাবে বেহালদশা কাটাতে রাজনৈতিক সময় বিবেচনায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই সাংগঠনিক পুনর্গঠন শেষ করতে চায় বিএনপি। সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে কর্মিসভা ও বর্ধিত সভা করা হচ্ছে।
জানা যায়, বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সংগঠনকে গুছিয়ে আনার বিষয়টি চলমান। বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে পুনর্গঠন করা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর কিছু বিতর্কিত অসাংগঠনিক কর্মকান্ডের কারণে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের একাধিক জেলা, উপজেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। তবে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়নি। মৎস্যজীবী দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও নতুন কমিটি দেওয়া হয়নি। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। তারেক রহমান জাতীয় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করতে যেভাবে বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন, একই ভাবে দলের সব স্তরে সাংগঠনিক কাজ গঠনমূলক ও কার্যকর করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, প্রায় ১৬ বছর ধরে দল পুনর্গঠনে বারবার হোঁচট খেয়েছেন তারা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমনও হয়েছে যে, কর্মিসভাও করতে দেয়নি পুলিশ। তবে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলেও সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করতে পারেনি দলটি। বরং অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে দলে সব ধরনের যোগদান কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এখন পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জেলা শাখার কমিটিগুলো পুনর্গঠন শেষ করতে চান।
জানা যায়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দেয় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বেশি জড়িত হওয়ায় সেই কাজ শেষ করতে পারেনি দলটি। এ ক্ষেত্রে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন করে বিএনপি। সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক জেলা শাখা কমিটি (মহানগরসহ) ৮২টি। ২০১৯ সালে বেশিরভাগ শাখায় আংশিক এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমানে যার অধিকাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে দীর্ঘ এই সময়ে বিভিন্ন ইউনিট কমিটি হালনাগাদও করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর দশটি জেলা ও মহানগরে পূর্ণাঙ্গ ও আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। তার মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম মহানগর, বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এবং সিলেট মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়। একই দিনে মৌলভীবাজার জেলা, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ দক্ষিণ এবং শেরপুর জেলা বিএনপির আংশিক আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদিত হয়েছে বলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
রংপুর বিভাগের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, রংপুরে দশটি সাংগঠনিক জেলা শাখায় আহ্বায়ক কমিটি হয়েছিল। যার মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। বাকি ৯টি শাখা কমিটির মেয়াদও শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, কমিটি পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। যতদ্রুত সম্ভব সব কমিটি পুনর্গঠন শেষ করার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। খুলনা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু বলেন, খুলনা বিভাগে ১১টি সাংগঠনিক জেলা শাখা কমিটি আছে। যার মধ্যে কেবল ঝিনাইদহ জেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। অন্যান্য জেলার কমিটিগুলোও পুনর্গঠনের কাজ চলমান আছে। আগামী ২৩ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সম্মেলন হবে বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলনের (কাউন্সিল) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। তবে প্রায় ৯ বছরেও কাউন্সিল করতে পারেনি দলটি। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দমনমূলক নীতি, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপেশাদার আচরণকে দায়ী করছে বিএনপি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সম্মেলন করার পরিকল্পনা নিলেও তার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। এ বিষয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। তবে দলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য ৯ বছরে শুধু কাউন্সিলই নয়, বিষয়ভিত্তিক ২৬টি উপ-কমিটিও গঠন করতে পারেনি বিএনপি। ফলে দলীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়ছেন অনেক ত্যাগী ও যোগ্য নেতা। আবার এক নেতার দখলে রয়েছে একাধিক পদ। এতে বিএনপিতে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না বলে পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূল নেতাদের দাবি। জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে কিছু বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকীয় পদ আছে। কিন্তু পদে থাকা নেতাদের কার্যক্রম একেবারেই সীমিত। এজন্য বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটিগুলো করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা চলছে। তারিখ নির্ধারণ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। নেতারা বলছেন, সর্বশেষ কাউন্সিলের পর ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দুটি জাতীয় নির্বাচন
একতরভাবে অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নিলেও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এই সময়ের মধ্যে একাধিকার জাতীয় কাউন্সিল করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। মূলত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় একজন সদস্য লিখিতভাবে দলের জাতীয় কাউন্সিলের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এরপর দলের বিভিন্ন ফোরামে কাউন্সিলের বিষয়টি আলোচনায় আসে। সেই থেকে প্রায় ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও নানাবিধ কারণে সম্মেলন করতে পারেনি বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দীর্ঘ এই সময়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা ও সাজানো মামলায় কারাবন্দি করা হয়। মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় লাখ লাখ নেতাকর্মীর জীবন বিপর্যস্ত। অনেকের ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠেছে। এরপরও যুক্তরাজ্যে থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নেতৃত্বে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন নতুনভাবে সারা দেশে মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোকে আরও গতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা শিগগির আরও গতি লাভ করবে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, বিএনপি হচ্ছে গণমানুষের দল। যার প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। কিন্তু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ গায়ের জোরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে। ফলে বিএনপি কাঙ্খিত সময়ে দল পুনর্গঠন শেষ করতে পারেনি। এদিকে সাম্যভিত্তিক ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে সারা দেশে দিকনির্দেশনামূলক যৌথ কর্মিসভা করছে জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। এ লক্ষ্যে সারা দেশে তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে দল গঠন করা হয়েছে। দলনেতারা মাঠে-ঘাটে চষে বেড়াচ্ছেন। কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কখনো ফসলের মাঠে কিংবা হাট-বাজারে গিয়ে চা-চক্রের আয়োজন করছেন এই তিন সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোনায়েম মুন্না বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা দেশের জনগণের কাছে যাচ্ছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের মনের ভাব অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। আর যাই হোক, দেশের মানুষ বিএনপিকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছেন বলে জানান মুন্না।